ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের গুণগত মান উন্নয়ন ও জনগণের প্রত্যাশা শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক ও জেলা জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক অধিপরামর্শ ফোরামের সদস্য মোঃ আনিছুর রহিম, সংবাদ সম্মেলনে সঞ্চালনা করেন স্বদেশ এর নির্বাহী পরিচালক ও ফোরামের সদস্য সচিব মাধব চন্দ্র দত্ত, আরও উপস্থিত ছিলেন ফোরামের সদস্য ও নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, সিনিয়র সাংবাদিক ও সাতক্ষীরা সাংবাদিক ঐক্যের আহবায়ক সুভাষ চৌধুরী, সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম মিনি, কালের চিত্রের সম্পাদক আবু আহম্মেদ, সাংবাদিক শরিফুল্লাহ কায়সার সুমন ও অন্যান্য সাংবাদিক প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলনে যে বিষয় তুলে ধরা হয়-
সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ একটি ঘূর্ণিঝড় প্রবণ দেশ। গত ১৫ বছরে সিডর(২০০৭), আইলা(২০০৯), বুলবুল(২০১৯) ও আম্ফানের(২০২০) মত ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে এ অঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রশমনমূলক ব্যবস্থা হিসেবে পর্যাপ্ত সংখ্যক ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের উপর জোর দিয়েছে। কিন্তু ভিন্ন দৃশ্যপট বলছে যে, জরুরী অবস্থার সময় অধিকাংশ মানুষ স্থানীয় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ে। দুর্যোগের বিভিন্ন বিপদসংকেত স¤পর্কে মানুষের মাঝে সঠিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে। উপরন্তু তারা প্রাই বিপদ সংকেতের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করে। এরকম পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয় যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাধারণ মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে লিডার্স একটি গবেষণা পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
গবেষণাটির প্রধান উদ্দেশ্য হলো বর্তমান আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা এবং আশ্রয়কেন্দ্রের প্রতি স্থানীয় জনগণের মনোভাব মুল্যায়ন করা । গবেষণায় বিভিন্ন সমস্যা উঠে আসে এবং সেই সকল তথ্য যেগুলোর কারণে তাদের মাঝে আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তরিত না হওয়ার প্রবণতা রয়েছে।
২০২০ সালের অক্টোবর মাসে শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন, আশাশুনির শ্রীউলা ইউনিয়ন এবং কয়রার দক্ষিণ-বেদকাশি ইউনিয়নের ৪৫০টি পরিবার থেকে প্রশ্নমালা ব্যাবহার করে তথ্য সংগ্রহ করে একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয় সেখানে তথ্য উত্তরদাতা ছিলেন ১৬৩১ জন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যাবস্থাপনা তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রত্যেক ইউনিয়ন থেকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত দুটি আশ্রয়কেন্দ্র নির্বাচন করা হয়। এই ইউনিয়নগুলো ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য উঠে এসেছে। যেমনঃ
ক. আশ্রয়কেন্দ্রের ধারণক্ষমতাঃ
১. শ্রীউলা ইউনিয়নের ৫টি আশ্রয়কেন্দ্রের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর সর্বোচ্চ মোট ধারণক্ষমতা ১৫,০০ জন। কিন্তু এই অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা ২৯,৩০০ জন। জনসংখ্যার বিচারে ধারণক্ষমতা ৫%।
২. বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের ১০টি আশ্রয়কেন্দ্রের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর মোট সক্ষমতা ৬,২৫০ জন। কিন্তু এলাকার মোট জনসংখ্যা ৩৭,৫০০ জন। জনসংখ্যার বিচারে ধারণক্ষমতা ১৭%।
৩. দক্ষিণ-বেদকাশি ইউনিয়নের ১২টি আশ্রয়কেন্দ্রের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর মোট সক্ষমতা ১২,৫০০ জন। তবে এলাকার মোট জনসংখ্যা ৩৫,৩০০ জন। জনসংখ্যার বিচারে ধারণক্ষমতা ৩৬%।
হিসেব করলে দেখা যায় ৩টি ইউনিয়নের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০% জনগণকে আশ্রয় দিতে সক্ষম।
খ. আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যাবস্থাপনাঃ
বেশিরভাগ আশ্রয়কেন্দ্র “স্কুল-কাম-আশ্রয়কেন্দ্র” হওয়ায় সেগুলো স্কুল পরিচালনা কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করতে এই কমিটি তেমন কোন ভূমিকা পালন করে না। তাদের অনেকেরই আশ্রয়কেন্দ্র ব্যাবস্থাপনার কোন পরিকল্পনা নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোন জরুরী অবস্থা সৃষ্টি হলে পরিচালনা কমিটি এসে হাজির হয় এবং তাড়াহুড়ো করে ব্যাবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করে। ফলে বিভিন্নরকম সমস্যার সৃষ্টি হয়।
গ. ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র স¤পর্কে মানুষের মিশ্র ধারণাঃ
প্রায় ৬৫% জনগণ (২৯২ টি পরিবার) জরুরী অবস্থায় আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। তবে ৩৫% জনগণ (১৫৮ টি পরিবার) বলেছে তারা আশ্রয়কেন্দ্রে যায় না। গবেষণায় দেখা গেছে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের মানুষের ভিতর আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি (৫৮ পরিবার)।
আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার কারণঃ
জরীপে অংশ নেওয়া ৯০৫ জন (৫৫.৪৯%, ১৬৩১ জনের মধ্যে) উত্তরদাতা আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। তাদের ৩২% (২৮৮ জন উত্তরদাতা) যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে বলেছে যে তারা আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপদ বোধ করে। ৩১% (২৭৭ জন উত্তরদাতা)উত্তরদাতা বলেছে দুর্যোগের সময় জলাবদ্ধতা এবং বন্যার সৃষ্টি হয় তাই তারা আশ্রয়কেন্দ্রে যায়। ৩০% (২৭৬ জন উত্তরদাতা)উত্তরদাতা বলেছে তাদের ঘরের অবস্থা ভালো না, তাই তারা আশ্রয়কেন্দ্রে যায়।
আশ্রয়কেন্দ্রে না যাওয়ার কারণঃ
জরীপে অংশ নেওয়া ৭২৬ জন উত্তরদাতা (৪৪.৫১%, ১৬৩১ জনের মধ্যে) আশ্রয়কেন্দ্রে না যাওয়ার কথা বলেছে। উত্তরদাতারা আশ্রয়কেন্দ্রে না যাওয়ার অনেক কারণ উল্লেখ করেছেন।
১. আশ্রয়কেন্দ্রে না যাওয়াদের ১৭% (১২০ জন উত্তরদাতা) মনেকরে আশ্রয়কেন্দ্র অতিরিক্ত জনবহুল। তাই সেখানে থাকা যায় না।
২. ১৫% (১০৭ জন উত্তরদাতা) উত্তরদাতা বলেছে যে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার রাস্তা এতোই খারাপ হয়ে যায় যে সেখানে পৌঁছানো যায় না।
৩. ১৪% (১০৩ জন উত্তরদাতা) উত্তরদাতা মনে করে আশ্রয়কেন্দ্রের অবস্থা এতোই খারাপ সেখানে থাকা যায় না।
উত্তরদাতারা অন্যান্য যে সমস্যার কথা প্রকাশ করেছেন-
১. বাড়ি থেকে আশ্রয়কেন্দ্রের দূরত্ব অনেক বেশি (১৩%, ৯৮ জন উত্তরদাতা)।
২. আশ্রয়কেন্দ্রে পানি, পয়-নিষ্কাশন এবং স্বাস্থ্যবিধি স¤পর্কিত সুযোগসুবিধার অভাব (১৩%, ৯১ জন উত্তরদাতা)।
৩. বাড়ির আসবাবপত্র, স¤পদ এবং গৃহপালিত প্রানি হারানোর ভয় (১১%, ৮০ জন উত্তরদাতা)।
৪. বাড়িতেই অনেকে নিরাপদবোধ করে (৬%, ৪৪ জন উত্তরদাতা)।
৫. আশ্রয়কেন্দ্রগুলো নারী ও শিশু বান্ধব নয় (৬%, ৪৫ জন উত্তরদাতা)।
৬. আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপত্তার অভাব (২%, ১৭ জন উত্তরদাতা)।
৭. আশ্রয়কেন্দ্র শারীরিকভাবে অক্ষম বা প্রতিবন্ধীবান্ধব নয় (২%, ১৭ জন উত্তরদাতা)।
গবেষণায় দেখা যায় উত্তরদাতাদের ১৬৭ (মোট উত্তরদাতার ৩৭%) টি পরিবার বলেছে তারা দুর্যোগের সময় বিকল্প আশ্রয় ব্যাবহার করে। তাদেও মধ্যে ৭২ টি (৪৩%) প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ৬৮ টি (৪০%) নিজের বাড়িতেই থাকে। ১৫ টি পরিবার (৯%) আত্বীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয় এবং ১২ টি পরিবার (৭%) ইউনিয়ন পরিসদের ভবনে আশ্রয় নেয়।
আশ্রয়কেন্দ্রে না যাওয়ার পিছনে জনগণের মনস্তাত্তি¡ক বাঁধা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি পরিবারের বয়স্কদের মাঝে অপেক্ষাকৃত বেশি লক্ষ্য করা যায়। তবে আশ্রয়কেন্দ্রের অব্যাবস্থাপনা ও বিভিন্ন সমস্যাই সেখানে না যাওয়ার সবথেকে বড় কারণ। তাই আশ্রয়কেন্দ্রের যথাযথ ব্যাবস্থাপনার প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে সেখানকার বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। নতুন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের সময় এই বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। সর্বোপরি মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলেই যেকোনো দুর্যোগে মানুষের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার হার বৃদ্ধি পাবে।
গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে আপনাদের মাধ্যমে নিম্নের সুনির্দ্দিষ্ট সুপারিশসমুহ তুলে ধরতে চাই;
১. উপকূলীয় অঞ্চলে পর্যাপ্ত সংখ্যক ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে।
২. বর্তমান আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর মান সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৩. আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর সুনির্দিষ্ট ব্যাবস্থাপনা কমিটি গঠন করতে হবে।
৪. আশ্রয়কেন্দ্রগুলো নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীবান্ধব করতে হবে।
৫. সর্বোপরি মানুষের মাঝে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের মনস্তাত্তি¡ক বাঁধা দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
No comments
please do not enter any spam link in the comment box.